রং ধরাতে টমেটোতে স্প্রে হচ্ছে ‘ইথোপেন’

রিপোর্টারের নাম
  • আপডেট সময় শনিবার, ২৫ জানুয়ারী, ২০২০

রাজশাহী প্রতিনিধি

মৌসুম অনুযায়ী ফল পাকার সময় হলে প্রাকৃতিকভাবেই তা পাকে। এ সময় প্রাকৃতিকভাবেই ফলে ইথিলিনের পরিমাণ বেড়ে যায়। ইথিলিন ফলের মধ্যে এক ধরনের এনজাইম নিঃসৃত করে। এমাইলেজের কাজ হলো ফলের জটিল শর্করাকে বিভাজন করে সাধারণ শর্করা বা সুক্রোজ এবং ফ্রুক্টোজে রূপান্তরিত করা।

 

এর ফলে ফল নরম ও সুস্বাদু হয়। পেকটিনেজ এনজাইমের কাজ হচ্ছে ফলের ত্বককে নরম করা। পাশাপাশি ত্বকের ক্লোরোফিল (যা সবুজ রঙ দেয়) পরিবর্তিত হয়ে কেরোটিনয়েড হয়ে যায়, এতে ফলের রং বদলে পাকা অর্থাৎ হলুদ বা লাল বর্ণ ধারণ করে। মূলত ফলে ইথিলিনের উপস্থিতি প্রাকৃতিক।

 

কিন্তু জমি থেকে সবুজ টমেটো তুলে ইথিলিন বা ইথোপেন স্প্রে করে টমেটো রঙিন করা হচ্ছে। আর এখানেই দেখা দিয়েছে যত বিপত্তি। যদিও কৃষি কর্মকর্তারা বলছেন- ইথোপেন স্প্রে করার পরও পরীক্ষায় টমোটোতে মানবদেহের জন্য ক্ষতিকর কোনো উপাদন পাওয়া যায়নি। সহনীয় পর্যায়ে স্প্রে করায় এটি এখনও নিরাপদ। এরপরও টমোটোর নমুনা নিয়ে বর্তমানে ল্যাবরেটরিতে ‘নিউট্রিশন স্ট্যাটাস’ পরীক্ষা করছে খ্যাদ্য মন্ত্রণালয়।

 

দেশের বাজারে রাজশাহীর টমেটো আসে সবার আগে। আবার থাকেও মৌসুমের শেষ পর্যন্ত। তাই বছরের এই সময়টা ব্যবসায়ীদের নজর থাকে রাজশাহীর ওপর। আর রাজশাহীতে শীত মৌসুমে টমেটো উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ থাকে সাড়ে ৩ হাজার হেক্টর জমিতে। যদিও এবার রাজশাহী জেলায় টমোটো উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা কমেছে।

 

কৃষি বিভাগের তথ্যানুযায়ী, এবার পুরো জেলায় ৩ হাজার ২শ’ হেক্টর জমিতে টমেটো উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। এর মধ্যে কেবল গোদাগাড়ী উপজেলাতেই ২ হাজার ১৫০ হেক্টর জমিতে টমেটো চাষ হয়েছে। যেখান থেকে ১ লাখ ৫৫ হাজার ৪৫ টন টমেটো উৎপাদন হবে বলে আশা করা হচ্ছে।

 

কৃষি বিভাগ বলছে, আমের পর রাজশাহীর অন্যতম অর্থকারী ফসল হচ্ছে টমেটো। বছরের নির্ধারিত এই মৌসুমে ৫ থেকে ৬ কোটি টাকার টমেটো কেনাবেচা হয়। রাজশাহীর গোদাগাড়ীর টমেটো রাজধানী ঢাকা, চট্টগ্রাম ও খুলনাসহ দেশের বিভিন্ন জেলার বাজারে সরবরাহ করা হয়ে থাকে।

 

এভাবেই দেশের চাহিদার একটি বড় অংশ পূরণ হয় রাজশাহীর টমেটো দিয়ে। আর রাজশাহীর টমেটো মানেই হচ্ছে- গোদাগাড়ীর টমেটো। কিন্তু এত পরিমাণ টমেটো কিভাবে উৎপাদন হচ্ছে, আর এত অল্প সময়ে পাকছেইবা কিভাবে? এই প্রশ্নের উত্তর খোঁজার চেষ্টা করেছে  ‘বাংলানিউজ’। সরেজমিন উত্তরের বরেন্দ্র অঞ্চলখ্যাত গোদাগাড়ীতে দিনভর চোখ রেখেছে বাংলানিউজের ক্যামেরা।

 

রাজশাহী-চাঁপাইনবাবগঞ্জ মহাসড়ক ধরে প্রায় ২২ কিলোমিটার পথ পেরোলেই গোদাগাড়ীর বসন্তপুর গ্রাম। সড়ক দিয়ে যেতে খালি চোখেই দেখা গেলো দু’পাশের জমি থেকে সদ্য তোলা সবুজ টমেটো রাখা হয়েছে রোদের ওপর। নিচে রয়েছে মোটা পলিথিন। সেই সবুজ টমেটোর ওপর প্রকাশ্যেই স্প্রে করা হচ্ছে।টমেটোতে স্প্রে করা হচ্ছেতবে ক্যামেরা নিয়ে সামনে যেতেই যেই কিশোর টমেটোতে স্প্রে করছিল সে দ্রুত সটকে পড়লো। কিন্তু এর আগেই ক্যামেরা বন্দি করা হয় স্প্রে করার ছবি। যদিও স্থানীয় কৃষকদের তোপের মুখে সেখানে কোনো কথা না বলেই ফিরতে হয়েছে। এরপরের কয়েকটি স্পটের চিত্র ছিল অভিন্ন। অবশেষ বোগদামারী গ্রামে গিয়ে টমেটোতে স্প্রে করা অবস্থায় কথা বলতে রাজি হন ফয়সাল নামের এক তরুণ কৃষক।

 

ফয়সাল নামের ওই কৃষক জানান, বোতলের গায়ে পরিমাণ দেখেই তারা ইথোপেন স্প্রে করে থাকেন। প্রতি ১৬ লিটার পানিতে ৫০ এমএল ইথোপেন মিশিয়ে স্প্রে করতে হয়। স্প্রে করার ১/২ দিনের মধ্যেই তা লাল অর্থাৎ পাকা রং ধারণ করে থাকে।

 

এরপর তারা জমি থেকেই প্লাস্টিকের ক্যারেটে ভরে ট্রাকে তুলে দেন। এভাবেই পর্যায়ক্রমে জমি থেকে টমেটো তোলা হচ্ছে এবং স্প্রে করে রোদে শুকিয়ে তা দেশের বিভিন্ন বাজারে সরবরাহ করা হচ্ছে। কেউ সবুজ টমেটো নিতে রাজি না হওয়ায় তারা বাধ্য হয়েই স্প্রে করছেন। কেবল তিনিই নন, উপজেলার প্রতিটি কৃষক একই প্রক্রিয়ায় টমেটো উৎপাদন ও বিপণন করছেন। সহনীয় মাত্রায় স্প্রে করায় এই টমেটো মানবদেহের জন্য কোনো ক্ষতির কারণ হবে না বলেও দাবি করেন এই কৃষক।

 

কিন্তু সত্যিই কি তাই? প্রশ্ন ছিল রাজশাহীর গোদাগাড়ী উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা শফিকুল ইসলামের কাছে। তিনি  বলেন, টমেটোতে ইথোপেনের মাত্রা ‘দশমিক ২ পিপিএম’ পর্যন্ত সহনীয়। এর চেয়ে বেশি হলেই তা স্বাস্থ্যের জন্য বিপজ্জনক।বাজারজাত করতে ভরা হচ্ছে প্যাকেটেতাই জনস্বাস্থ্যের কথা চিন্তা করে মাঝেমধ্যেই কৃষি বিভাগ বিভিন্ন এলাকা থেকে নমুনা সংগ্রহ করে ল্যাবরেটরিতে পরীক্ষা করে থাকে। খাদ্যমন্ত্রীর নির্দেশে গত সপ্তাহেও গোদাগাড়ীর ২০টি স্পট থেকে নমুনা সংগ্রহ করে মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছিল।

বাজারজাত করতে ভরা হচ্ছে প্যাকেটে

সেখান থেকে ল্যাবরেটরিতে এই নমুনা পরীক্ষা করা হয়েছে। কিন্তু কোনো ক্ষতিকর উপাদান পাওয়া যায়নি। এটি ছিল চতুর্থবারের মত পরীক্ষা। এর আগেও তিনবার টমেটো পরীক্ষা করা হয়েছে। কিন্তু তেমন ক্ষতিকর কিছুই মেলেনি।

 

এরপরও খাদ্যমন্ত্রীর নির্দেশে আবারও তিনটি স্পট থেকে নমুনা সংগ্রহ করে পাঠানো হয়েছে। এই নমুনা দিয়ে ‘নিউট্রিশন স্ট্যাটাস’ পরীক্ষা করা হচ্ছে। টমেটোতে ইথোপন স্প্রে করার পর ক্ষতিকারক কিছু না পাওয়া গেলেও এর পুষ্টিগুণ ঠিক থাকছে কিনা এখন সেটি পরীক্ষা করে দেখা হচ্ছে বলেও উল্লেখ করেন উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা।

 

আর কৃষকরা বাধ্য হয়েই টমেটোতে রং ধরানোর জন্য স্প্রে করছেন। কারণ পুষ্ট হলেও সাধারণ মানুষের মধ্যে সবুজ টমেটো খাওয়ার অভ্যেস গড়ে ওঠেনি। অথচ সবুজ টমেটো ঘরে রাখলে প্রাকৃতিকভাবেই লাল হয়ে যায়। কারণ টমেটো পুষ্ট হওয়ার পর প্রাকৃতিকভাবেই ইথিলিনের পরিমাণ বেড়ে যায়। ফলে ঘরে রেখে দিলেও লাল হয়ে যায়। কিন্তু সবাই এখনও মনে করেন টমেটো কেবল লাল হলেই পাকা হয়। ভোক্তাদের বদ্ধমূল এই ধারণা বদলাতে না পেরে কৃষকরা টমেটো লাল করতে স্প্রে করছেন।

 

কিন্তু ফল পাকানোর জন্য ইথোপনের ব্যবহার বন্ধে সরকারের কঠোর নির্দেশনা রয়েছে। তবে কৃষকদের স্বার্থের কথা বিবেচনায় এ ব্যাপারে এখনও কঠোর হওয়া যাচ্ছে না। আবার জনস্বাস্থ্য ও সরকারি নির্দেশনাও অমান্য করা যাচ্ছে না। এতে তারা উভয় সংকটে পড়েছেন। কারণ খুব স্বল্প সময়ই টমেটোর ওপরে এ হরমোনটি থাকে।

 

তাই কৃষি বিভাগ টমেটোতে এ হরমোন স্প্রে করতে সাধারণত কোনো বাধা দেয় না। কিন্তু তারপরও নেতিবাচক প্রচারণায় টমেটোর বাজার খারাপ হয়ে আসছে। কৃষকরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। এ কারণে গোদাগাড়ীতে দিনদিন টমেটো চাষও কমছে।

 

রাজশাহী কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপ-পরিচালক (ডিডি) শামসুল আলম। তিনি  বলেন, বাজার ধরতে কৃষকরা বাধ্য হয়ে টমেটোয় স্প্রে করছেন। তবে এখন পর্যন্ত চারবার পরীক্ষা করা হলেও ক্ষতিকর কিছু পাওয়া যায়নি। এরপরও ইথোপেনের গায়ে লেখা আছে এটি ফল পাকানোর জন্য নয়। তাই এর ব্যবহাররোধে দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে। পাশাপাশি সবাইকে পরিপক্ক সবুজ টমেটো খাওয়ার ব্যাপারেও উদ্বুদ্ধকরণ কর্মসূচি হাতে নেওয়া হচ্ছে। এই খাদ্যসংস্কৃতি গড়ে তুলতে পারলে স্বাস্থ্যঝুঁকি খুব সহজেই এড়ানো যাবে বলে উল্লেখ করে ঊর্ধ্বতন এই কৃষি কর্মকর্তা।

 

শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এই বিভাগের আরো খবর
All rights reserved www.mzamin.news Copyright © 2023