প্রচণ্ড ঠাণ্ডা আর হিম বাতাসে করুণ দশা চরাঞ্চলের মানুষের
‘শুনছম সরকার নাকি কম্বল দিবার নাকছে, মোরখ্যান কই বাপো?’
রিপোর্টারের নাম
  • আপডেট সময় শনিবার, ১১ জানুয়ারী, ২০২০

স্টাফ রিপোর্টার, গাইবান্ধা

গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জ উপজেলার হরিপুর ইউনিয়নের চরিতাবাড়ির চর। চরে তিস্তা নদীর পাড়ে বসে আছেন ষাটোর্ধ্ব বৃদ্ধা মহিরন বেওয়া। ঠাণ্ডায় একটুখানি উষ্ণতা পেতে সূর্যের তাপে বসে তিনি। শরীরে জড়ানো পরনের কাপড়ে জবুথবু বৃদ্ধা। পরনে গরম কাপড় না থাকায় সূর্যের উষ্ণতা পাওয়ার চেষ্টা। নদীর ধারে বইছে শীতল বাতাস। তবুও শরীরে কিছুটা উষ্ণ ঝলমলে রোদের শান্তির আভাস। এভাবেই প্রতিটি দিন কেটে যায় চরাঞ্চলে বসবাস করা নারী-পুরুষ ও শিশুদের। যেদিন সূর্যের দেখা মেলে না, সেদিন আগুনের তাপে হাত-পা সেঁকে নিরুত্তাপ শরীরে উষ্ণতা জোগায় তারা।

এভাবে দিনের বেলা কেটে গেলেও সন্ধ্যা নামার সাথে সাথে বেড়ে যায় দুর্ভোগের মাত্র। কনকনে শীত আর হিমেল বাতাস হু হু করে ঢোকে খুপরি ঘরে। ঠাণ্ডা মোকাবেলায় গরম কাপড় না থাকলেও দরিদ্র পরিবারের মানুষগুলো শীতের মতো বড় বিপদ থেকে বাচঁতে বার বার ছুটে যান আগুনের কাছে। মায়েরা নিজের শরীরের উষ্ণতা দিয়ে নিরুত্তাপ সন্তানদের বাচাঁনোর চেষ্টা করেন। প্রচণ্ড ঠাণ্ডা আর হিম বাতাসে তিস্তা ও ব্রহ্মপুত্র নদের দুর্গম চর-দ্বীপচরে বসবাস করা মানুষগুলোর জনজীবনে চরম দুর্ভোগ নেমে এসেছে। গরম কাপড়ের অভাবে অনেকের দিন কেটে যায় সূর্যের অপেক্ষায়। কেউ আবার খরকুটোর আগুনে নিবারণ করছেন শীত।

মজিরন বেওয়া বলেন, নাতিপুতিদের নিয়ে অনেক কষ্টে আছমবা। মোর বয়স হইছে সেজন্য ঠাণ্ডাও নাগে মেলা। শীতের কাপড় কিনবার না পায়া সারারাইত কষ্ট করি কাটে। নদীত থাকি আসা বাতাত হু হু করি ঘরত ঢোকে। শুনছম সরকার নাকি কম্বল দিবার নাকছে, কিন্তু মোরখ্যান কই বাপো?

সূত্র মতে, চলতি শীত মৌসুমে উপজেলা প্রশাসন এ পর্যন্ত সরকারিভাবে মাত্র নয় হাজার কম্বল বিতরণ করেছে। একটি পৌরসভা ও ১৫টি ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যানদের মাধ্যমে এসব কম্বল বিতরণ করা হয়। এর মধ্যে ছয়টি ইউনিয়ন একেবারে তিস্তা ও ব্রহ্মপুত্র নদবেষ্টিত। তিস্তা ও ব্রহ্মপুত্র নদবেষ্টিত হরিপুর, তারাপুর, চন্ডিপুর, কাপাসিয়া, বেলকা ও শ্রীপুর ইউনিয়নের ৩০টি চরে প্রায় এক লাখ মানুষের বসবাস। এদের অধিকাংশ মানুষ একেবারে দরিদ্রসীমার নিচে বসবাস করে। তারা তীব্র ঠাণ্ডায় কষ্ট পেলেও শীতবস্ত্র হাতে পাশে দাঁড়ায় না স্থানীয় রাজনৈতিক নেতা ও জনপ্রতিনিধিরা। প্রতিটি ইউনিয়ন পরিষদ মাত্র ৪২০টি করে কম্বল বরাদ্দ পেয়েছে। আর এসব কম্বল ওয়ার্ড সদস্যদের মাঝে ৩০টি করে ভাগাভাগি করা হয়। যা একেবারে নগণ্য। আর এসব কম্বল স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের স্বজনপ্রীতির কারণে প্রকৃত দুস্থদের ভাগ্যে জোটে না।

এদিকে, কনকনে ঠাণ্ডা আর শৈত্যপ্রবাহের সাথে হিমেল বাতাসে কাহিল উপজেলার খেটে খাওয়া মানুষ। কারো গায়ে জড়িয়ে আছে পুরনো শীতের পোশাক। আবার কেউবা বাড়ির কাঁথা গায়ে জড়িয়ে মোকাবেলা করছেন শীত। এই ঠাণ্ডার তোড়ে জবুথবু নিম্ন আয়ের মানুষের একমাত্র ভরসা খরকুটোর আগুন। শীতকালে খরকুটোর আগুনের সামান্য উষ্ণতা আর পুরনো ছেঁড়াফুটো গরম কাপড় এসব এলাকার মানুষের নিত্যসঙ্গী। শহর-গ্রামে অনেকেই গরম কাপড় হাতে শীতার্তদের পাশে দাঁড়ালেও নদী পার হয়ে দুর্গম চরে পৌঁছায় না এসব শীতবস্ত্র। আর শীতার্তদের মাঝে কম্বল বিতরণ করা হলেও শিশু-কিশোরদের জন্য দেওয়া হয় না কোনো শীতবস্ত্র। গরম কাপড় কিনতে না পারা ছিন্নমূলর শিশুদের অবস্থা আরো কাহিল। আগুনে হাত-পা সেঁকে কোনরকম দিন চলে যায় তাদের। চরের শিশু-কিশোরদের চরম কষ্ট করে বিদ্যালয়ে যেতে হয়। আবার শৈত্যপ্রবাহ বাড়লে স্কুলে না গিয়ে বাড়িতে কাঁথা মুরি দিয়ে শুয়ে থাকেন অনেকে। ফলে ঠাণ্ডাজনিত রোগে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছেন শিশু ও বয়স্করা।

চলতি বছরের কয়েক দফা বন্যা আর নদী ভাঙনের ধকল সামলে উঠতে না উঠতেই শীতে কাতর হয়ে পড়েছে এ উপজেলার চরাঞ্চলের মানুষ। বিপর্যস্ত ব্রহ্মপুত্র ও তিস্তা নদীবেষ্টিত চরাঞ্চলে বসবাসরত খেটে খাওয়া মানুষের জনজীবন। এ জনপদের অধিকাংশ খেটে খাওয়া মানুষের ভরসা সূর্য। এরপর সন্ধ্যা নামলেই শুরু হয় দুর্ভোগ। নদীর ঠাণ্ডা হাওয়া শীতের তীব্রতা আরো বাড়িয়ে দেয়। হিম বাতাস ঢোকে তীরবর্তী ঘরগুলোতে।

অন্যদিকে, হার কাপাঁনো ঠান্ডায় যোগ হচ্ছে শীতজনিত রোগ। শিশু ও বয়স্করা দুর্ভোগের পাশাপাশি শীতজনিত নানা রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন তারা। ডায়রিয়া, নিউমোনিয়া ও শ্বাসকষ্টে আক্রান্ত হয়ে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি হচ্ছে অনেক শিশু ও বয়স্করা। শুধু মানুষ নয়, শীতের হাত থেকে রক্ষা পাচ্ছে না পশুপাখি। গেলো সপ্তাহে বেশকিছু চরে অন্তত ৫টি গরু এবং তিনটি ছাগল মারা যাওয়ার খবর পাওয়া গেছে। আর বিভিন্ন রাজনৈতিক ও সামাজিক সংগঠনগুলো নানা সময়ে শীতবস্ত্র হাতে শীতার্তদের কাছে গেলেও নদীর ওপারে বসবাস করা মানুষের পাশে দাঁড়ায় না কেউ।

ঘন কুয়াশা আর বাতাসে ব্যাহত হচ্ছে জনজীবন। ক্ষেত খামারে কাজ করে সংসার চালানো মানুষরা চরম বিপাকে পড়েছেন। কৃষিকাজে যোগ দিতে না পারায় দুর্ভোগ বেড়েছে বেশি। শীতে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে রোপা বীজতলা, সরিষা, বাদাম, পেয়াঁজ ও শাক-সবজিসহ কৃষি ফসল। সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে বীজতলা। ফ্যাকাসে বর্ণ হয়ে কুঁকড়ে যাচ্ছে বীজতলা। ফসলী জমিতে পানি সেচ দিয়ে রক্ষার চেষ্টা করছেন কৃষকরা। তবে শীতে রোগ বালাইয়ে আক্রান্ত ফসল রক্ষায় স্থানীয় কৃষি বিভাগের সহায়তা না পাওয়ার অভিযোগ স্থানীয়দের।

হরিপুর ইউনিয়নের চর চরিতাবাড়ি গ্রামের বৃদ্ধ মজিবর রহমান বলেন, নদীর পারত বাড়ি করি থাকা আর যুদ্ধ করা একে কথা। এই ঠাণ্ডাত হামার কষ্ট কেউ দেখে না বাহে। চেয়ারম্যান মেম্বাররা নাকি কম্বল দেয় মুইত একনাও পানু না।

একই গ্রামের বাসিন্দা মোসলেম আলী বলেন, একবার বান, আরেকবার নদী ভাঙা, ফির শীত এগলা নিয়াই হামরা নদীর পারত থাকি। কেউ কোনদিন হামার গুলার খবর নিবার জন্য নদী পার হয়া আইসে না। মুই গরীব মানুষ। ঠিকমতো তিন বেলা খাবার জোগাড় করবার পামনা। শীতের কাপড় কিনবার না পায়া বাড়ির খেতা (কাঁথা) গাত দিয়া আছম।

হরিপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান নাফিউল ইসলাম জিমি কালের কণ্ঠকে বলেন, এ জনপদের খেটে খাওয়া মানুষগুলো শীতে প্রচণ্ড কষ্ট পাচ্ছেন। তাদের পাশে দাঁড়ানোর মতো কেউ নেই। তিস্তা ও ব্রহ্মপুত্র নদের মাঝখানে বসবাস করা মানুষগুলো বড্ড অসহায়। এখানকার মানুষগুলোকে প্রতিনিয়ত প্রাকৃতিক দুর্যোগের সাথে লড়াই করে বেচেঁ থাকতে হয়। নদী ভাঙন আর বন্যায় বারবার ক্ষতিগ্রস্থ মানুষগুলোর ভাগ্যের পরিবর্তন ঘটে না কোনদিন।

চরাঞ্চলের মানুষের কথা মাথায় আছে জানিয়ে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সোলেমান আলী বলেন, এ পর্যন্ত সরকারিভাবে নয় হাজার কম্বল বিতরণ করা হয়েছে। এ উপজেলায় জনবসতি অনেক বেশি। অল্প বরাদ্দ দিয়ে সবার চাহিদা মেটানো সম্ভব নয়। আমরা চাহিদাসহ বরাদ্দের আবেদন পাঠিয়েছি, পেলে বণ্টন করা হবে।

চরাঞ্চলের শীতার্ত মানুষের পাশে দাড়াঁনোর কথা জানিয়ে গাইবান্ধা-১ (সুন্দরগঞ্জ) আসনের সংসদ সদস্য ব্যারিস্টার শামীম হায়দার পাটোয়ারী বলেন, আমার ব্যক্তিগত অর্থে এ পর্যন্ত ১২ হাজার শীতার্তদের মাঝে কম্বল বিতরণ করেছি। আরো দশ হাজার কম্বল বিতরণ করবো। এসব কম্বল চরাঞ্চলের মানুষের মাঝে বিতরণ করার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে বলেও জানান তিনি।

শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এই বিভাগের আরো খবর
All rights reserved www.mzamin.news Copyright © 2023