মুক্তিযুদ্ধের পর দারিদ্র্যের বিরুদ্ধে সংগ্রামের আহ্বান বঙ্গবন্ধুর

রিপোর্টারের নাম
  • আপডেট সময় রবিবার, ৯ ফেব্রুয়ারী, ২০২০

স্টাফ রিপোর্টার, ঢাকা

সেই ৭ মার্চ ১৯৭১-এ রেসকোর্সে দাঁড়িয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ঘোষণা দিয়েছিলেন— এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম,এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম। ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ শেষে ১৬ ডিসেম্বর জন্ম নেয় স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ।  এর ঠিক একবছর পরে ১৯৭২ সালের এই দিনে বঙ্গবন্ধু জাতি গঠনে এগিয়ে আসতে জনগণকে আহ্বান জানিয়ে বলেন,‘এবারের সংগ্রাম দারিদ্র্যের বিরুদ্ধে সংগ্রাম।’ ততদিনে ৭৬ লাখ উদ্বাস্তু ভারত থেকে বাংলাদেশে ফিরে এসেছে। পাকিস্তান তখনও নানা কূটকৌশল অব্যাহত রেখেছে। আর বঙ্গবন্ধু তখন ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছেন দেশ পুনর্গঠন, অর্থনৈতিক কাঠামো নির্মাণ,আর বন্ধুরাষ্ট্রের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন নিয়ে।

 

দারিদ্র্যের বিরুদ্ধে সংগ্রামের পথে

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান দেশের সমগ্র জনশক্তি ও বৈষয়িক সম্পদ পুরোপুরিভাবে কাজে লাগানোর নীতি গ্রহণের আহ্বান জানান। ৯ ফেব্রুয়ারি (বুধবার) প্রদত্ত এক বিবৃতিতে প্রধানমন্ত্রী দারিদ্র্য, ক্ষুধা, ও আশ্রয়ের অভাবের বিরুদ্ধে সংগ্রাম শুরু করতে আহ্বান জানান। তিনি বলেন, ‘প্রতিটি নারী-পুরুষ ও শিশুর জন্য অন্ন, বস্ত্র, আশ্রয়, স্বাস্থ্য ও শিক্ষা নিশ্চিত করে সমাজ প্রতিষ্ঠিত না হওয়া পর্যন্ত আমাদের সংগ্রাম চলবেই। তখনই কেবল জনগণের ঐতিহাসিক বিজয়ের মধ্য দিয়ে এই স্বাধীনতা সংগ্রাম সমাপ্ত হবে। এখন আমাদের ব্রত হতে হবে যে সমাজ প্রতিষ্ঠার জন্য, সেই সংগ্রামের শর্ত হচ্ছে— আমাদের শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলোকে পুরোপুরি উৎপাদনে সচেষ্ট হতে হবে।’ দ্বিতীয় পর্যায়ে সংগ্রামে অগ্রণী ভূমিকা গ্রহণের জন্য শ্রমিকদের প্রতি আহ্বান জানান এবং কৃষকদের এই জাতি গঠনের সংগ্রামে শরিক হতে বলেন। বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘আমাদের জাতীয় কর্মসূচি চালিয়ে যাচ্ছি। তবে কোনও জাতি ধার করা সম্পদ দিয়ে নিজেকে সত্যিকারভাবে গড়ে তুলতে পারে না। আমরা চাই, সমগ্র জাতি পুনর্গঠন কাজে এগিয়ে আসুন। সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টার মাধ্যমে আমরা এই দ্বিতীয় পর্যায়ের সংগ্রামে বিজয়ী হবো বলে আমার বিশ্বাস। যে ন্যায়সঙ্গত সমাজ প্রতিষ্ঠার জন্য লাখো লোক প্রাণ দিয়েছে, সবাই মিলে কাজে হাত দিয়ে আমরা সেই সমাজ প্রতিষ্ঠা করতে পারবো।’

 

ডাক ‍ছিল ‍কৃষক-শ্রমিক-সরকারি চাকুরে সবার প্রতি

বঙ্গবন্ধু এই সংগ্রামের সঙ্গী হতে বিবৃতির মধ্য দিয়ে আহ্বান জানান, বাংলার কৃষক-শ্রমিক-সরকারি চাকুরে থেকে শুরু করে সবার প্রতি। দেশের পরিস্থিতি বিবৃত করে তিনি বলেন, ‘এই অবস্থা থেকে ঘুরে দাঁড়াতে হলে সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টা প্রয়োজন। কৃষকদের উদ্দেশ্যে তিনি বলেন, আমাদের বীর কৃষকদের প্রিয় জাতি গঠনের কাজে অংশ নিতে হবে। দেশের কৃষি ব্যবস্থাকে পুনর্গঠন কাজে কৃষকরা যেন এক বিশিষ্ট ভূমিকা পালন করতে পারে, সেজন্য সরকারের পক্ষ থেকে ব্যবস্থা করা হচ্ছে।’ সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের উদ্দেশে তিনি বলেন, ‘সরকারি চাকুরেদের স্মরণ রাখতে হবে যে, তারা জনগণের সেবক। জাতীয় লক্ষ্য অর্জনের জন্য তাদেরকে কাজ করে যেতে হবে।’ বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘আমি বিশ্বাস করি, গ্রামবাসী ভাইদের অবস্থা আপনারা জানেন, আপনারা জানেন যে, ফিরে আসা এক কোটি শরণার্থীর দুর্দশার কাহিনী। দেশের অভ্যন্তরে দুই কোটি মানুষ সর্বহারা হয়েছে। তাও আপনাদের অজানা নয়। এত কিছু জানার পর আপনারা নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন, এখনই আপনাদের বেতন বাড়াতে হলে উন্নয়ন ও গঠনমূলক কাজকে বাধাগ্রস্ত করতেই হবে। সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতি প্রতিষ্ঠা হলে দেশের কল্যাণ ও ন্যায়সঙ্গত অধিকার প্রতিষ্ঠা সম্ভব হবে।’

 

ভারতের সঙ্গে আলোচনায় আগ্রহী নিক্সন

যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নিক্সন ভারতের সঙ্গে আলোচনা করতে চান।  সাম্প্রতিক যুদ্ধের বিষয়ে মার্কিন নীতির যৌক্তিকতা ব্যাখ্যা করতে গিয়ে  নিক্সন  বলেন যে, তার সরকার ভবিষ্যত সম্পর্কের ব্যাপারে ভারতের সঙ্গে একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈঠকে বসতে প্রস্তুত। মার্কিন কংগ্রেসে প্রদত্ত বাণীতে তিনি বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্র সরকার ভারতের সঙ্গে আলোচনায় আগ্রহী।’ তিনি বলেন যে, ‘নয়া সম্পর্কনীতি মিলনভিত্তিক নয়, বরং তা হবে উভয়ের মতামত ও স্বার্থের প্রতি শ্রদ্ধাভিত্তিক।’ দুপক্ষের ক্ষেত্রেই এটি প্রযোজ্য হবে বলেও তিনি উল্লেখ করেন।

 

নিক্সন জানান, যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তানের ঘনিষ্ঠই থাকবে। তিনি বলেন, ‘একটি সংকটের অবসানের সঙ্গে সঙ্গে পাকিস্তানি জনগণের কল্যাণ ও নিরাপত্তার বিষয়ে আমাদের উদ্বেগ শেষ হয়ে যাবে না।’ তিনি বলেন যে, ‘পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যেকোনও যুদ্ধে ভারতই জয়লাভ ‘মার্কিন সরকার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ফাঁসি দেওয়ার ব্যাপারে পাকিস্তানের সাবেক প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানকে বিরত রেখেছিলেন।’ তিনি আরও  দাবি করেন, যুক্তরাষ্ট্র ডিসেম্বরের শুরুতে প্রমাণ পায় যে, ভারত কাশ্মিরে পাকিস্তানের অধিকৃত এলাকা দখল এবং পশ্চিম পাকিস্তানের সামরিক শক্তি ধংস করার কথা ভাবছে।

 

তিনি এও বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্র নভেম্বরের প্রথম দিকে কলকাতার বাঙালি প্রতিনিধিদের সঙ্গে যোগাযোগ করেছিল। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া যুক্তরাষ্ট্রকে জানিয়েছিলেন যে, তিনি পাকিস্তানে সাংঘাতিক অপরাধের দায়ে অভিযুক্ত ব্যক্তি ছাড়া উক্ত গ্রুপের যেকোনও প্রতিনিধি এবং তখন পর্যন্ত পূর্ব পাকিস্তানে অবস্থানকারী আওয়ামী লীগ নেতাদের সঙ্গে আলোচনা করতে প্রস্তুত রয়েছেন।’

 

পাকিস্তান বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেবে, তবে…

পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ভুট্টো বলেছেন যে, পাকিস্তান বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেবে। তবে তার সঙ্গে শেখ মুজিবুর রহমানের আলোচনার পরই কেবল সেটা হতে পারে। ভয়েস অব আমেরিকা ও বিবিসির বরাত দিয়ে বাসস পরিবেশিত খবরে প্রকাশ করা হয়, এই দিনে বাংলাদেশ থেকে ভারতীয় সৈন্য প্রত্যাহারের পর ভুট্টো ঢাকা সফরের ইচ্ছে প্রকাশ করেন।

 

 

ইন্দিরা বাংলাদেশে আসবেন ১৭ মার্চ

ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী  আগামী ১৭ মার্চ স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশে সফরে আসবেন বলে ভারতীয় সংবাদপত্রে খবর প্রকাশ করা হয়েছে। ওই দিনটি আবার জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের জন্মদিনও। সম্প্রতি ভারত সফর থেকে ফিরেছেন বঙ্গবন্ধু। দুদেশের মধ্যকার বেশ কিছু বিষয়ে মতৈক্যে পৌঁছানো সম্ভব হয়েছে বলে দেশি-বিদেশি সংবাদমাধ্যমে জানানো হয়। ইতোমধ্যে ৭৬ লাখেরও উদ্বাস্তু দেশে ফিরেছে। পুনর্বাসন দপ্তফতরের মুখপাত্র জানিয়েছেন, ভারতের বিভিন্ন রাজ্য থেকে এ পর্যন্ত ৭৬ লাখ ৬৬ হাজার ৫৬৫ ব্যক্তি দেশে ফিরেছেন।

শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এই বিভাগের আরো খবর
All rights reserved www.mzamin.news Copyright © 2023