প্রয়োজনে ফেরত দেওয়ার কথা বলে অস্ত্র জমা নেন বঙ্গবন্ধু

রিপোর্টারের নাম
  • আপডেট সময় বৃহস্পতিবার, ৩০ জানুয়ারী, ২০২০

স্টাফ রিপোর্টার, ঢাকা

চিরদিনের জন্য আমি আপনাদের কাছ থেকে অস্ত্র নিচ্ছি না। প্রয়োজন হলে আমাদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রকারীদের মোকাবিলা করার জন্য আমি আবারও আপনাদের অস্ত্র ফেরত দেবো। ১৯৭২ সালের ৩০ জানুয়ারি স্টেডিয়ামে গেরিলা বাহিনীর কাছ থেকে অস্ত্র জমা নেওয়ার সময় শত্রুদের ষড়যন্ত্রের প্রতি সতর্ক থাকার নির্দেশ দিতে গিয়ে  বঙ্গবন্ধু তার বক্তৃতায় এসব কথা বলেন। এই দিন বাংলাদেশ ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি ও বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়নের নেতাদের অস্ত্র সমর্পণ অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখেন বঙ্গবন্ধু। প্রধানমন্ত্রীর অফিস থেকে মুক্তিযুদ্ধে হতাহত ও নিখোঁজদের তালিকা প্রণয়নের জন্য তথ্য চাওয়া হয় এইদিনে। এছাড়া, বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেওয়ার ঘোষণা আসায় পাকিস্তান কমনওয়েলথ থেকে বেরিয়ে যাওয়ার খবর গুরুত্ব দিয়ে প্রকাশ হয় পত্রিকাগুলোতে।

আমরা জালেমের বিরুদ্ধে

বঙ্গবন্ধু আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানের বক্তৃতায় বলেন, ‘পশ্চিম পাকিস্তানের জনগণের বিরুদ্ধে নই আমরা, আমরা জালেমের বিরুদ্ধে।’ তিনি বলেন, ‘দফতরে যখন কাগজ নিয়ে বসি তখন দেখি, জালেমরা আমাদের সোনার বাংলাকে শ্মশান করে গেছে। তবে তারা আমরা সোনার বাংলার মাটিকে নিতে পারেনি। এই মাটিতেই সোনার বাংলা গড়ে তুলতে হবে।’ তিনি বলেন, ‘স্বাধীনতা লাভ করা যেমন কঠিন, রক্ষা করাও সমান কঠিন। জনগণের জন্য গণতন্ত্র ও শিক্ষার ব্যবস্থা করা হলেই, তারা সত্যিকারের স্বাধীনতা ভোগ করতে পারবেন। বাংলাদেশে গণতন্ত্র হবে। সমাজতন্ত্র আসবে এবং ধর্মনিরপেক্ষতা কায়েম হবে।’ গেরিলা বাহিনী অস্ত্র জমা দিলে প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমান জনগণকে সতর্ক করে বলেছেন, সাম্রাজ্যবাদ ও তাদের অনুচররা এখনও বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছে। অনেক রক্তের বিনিময়ে অর্জিত আমাদের স্বাধীনতার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রকে মোকাবিলা ও রুখে দিতে প্রস্তুত থাকতে বলেন তিনি। সমবেত মুক্তিযোদ্ধা ও জনতার উদ্দেশে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘আমাদের সংগ্রাম কোনও দেশের সাধারণ জনগণের জন্য না। আমরা ষড়যন্ত্র রুখে দাঁড়াবো। আমেরিকা হোক বা অন্য যেকোনও দেশই হোক, যারাই ষড়যন্ত্র করবে, ঐক্যবদ্ধভাবে তাদের প্রতিরোধ করা হবে।’ অস্ত্র সমর্পণের পরে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির সাধারণ সম্পাদক আবদুস সালাম বলেন, ‘আমরা সমাজতন্ত্রের জন্য লড়াই  করেছি, সরকার সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠান ঘোষণা দিয়েছে। বঙ্গবন্ধু যে পদক্ষেপ নেবেন, তা সাফল্যমণ্ডিত করতে আমরা কাজ করবো।’

ষড়যন্ত্রকারীদের বিরুদ্ধে সতর্ক থাকতে হবে

স্বাধীনতার জন্য জনগণ রক্ত দিয়েছে। স্বাধীনতা রক্ষার জন্য প্রয়োজনে আরও রক্ত দেবে, উল্লেখ করে আগের দিন বাসাবোতে বাংলাদেশের গেরিলা বাহিনীর ঢাকা কমান্ড আয়োজিত এক অস্ত্র জমা নেওয়া অনুষ্ঠানে বঙ্গবন্ধু ফের হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে বলেন, ‘ষড়যন্ত্রকারীদের বিরুদ্ধে সতর্ক থাকতে হবে।’ বঙ্গবন্ধু মুক্তিযোদ্ধাদেরকে জাতীয় মিলিশিয়া বাহিনী, পুলিশ বাহিনী ও সশস্ত্রবাহিনীতে যোগ দেওয়ার আহ্বান জানান। মুক্তি সংগ্রামীদের আত্মত্যাগের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘স্বাধীনতার জন্য শহীদ ভাইয়েরা জীবন দিয়ে গেছেন। আপনারা সংগ্রাম করেছেন জালেমদের বিরুদ্ধে। তারা আমাদের জনগণকে হত্যা করেছে। গ্রামের পর গ্রাম পুড়িয়ে ছারখার করেছে। আমাদের মা-বোনদের ওপর তারা অমানসিক অত্যাচার করেছে। বাংলার জনগণের প্রতি ইনসাফ করে ও শোষণ বন্ধ করে শহীদদের রক্তের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করতে হবে।’

বাংলাদেশকে স্বীকৃতি: কমনওয়েলথ  ছাড়লো পাকিস্তান

দৈনিক বাংলার আজকের (৩০ জানুয়ারি) সংবাদে প্রকাশ করা— পাকিস্তান গোস্বা করে কমনওয়েলথ ছেড়ে দিয়েছে। কমনওয়েলথের তিন প্রধান সদস্য রাষ্ট্র বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়ায় পাকিস্তানের এই অভিমান। এই তিনটি দেশ হচ্ছে— ব্রিটেন অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ড। এরমধ্যে অস্ট্রেলিয়া এবং নিউজিল্যান্ড ৩১ জানুয়ারিতেই বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়। পাকিস্তান বেতারের এক ঘোষণায় বলা হয়— বিশেষত ব্রিটেন বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেওয়ার কথা বলায়, পাকিস্তান তাদের প্রতিবাদ স্বরূপ কমনওয়েলথের সঙ্গে ২৪ বছরের সম্পর্ক ছিন্ন করছে। পাকিস্তানের জনগণের ইচ্ছে অনুযায়ী এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে বলেও জানানো হয়। এদিকে ভুট্টোর সঙ্গে আলোচনার জন্য কমনওয়েলথ সেক্রেটারি আর্নল্ড স্মিথ রাওয়ালপিন্ডি গিয়ে এই সম্পর্কচ্ছেদের বিষয়ে জানতে পারেন। পাকিস্তানে এক জরুরি সংবাদ সম্মেলনে ভুট্টো বলেন, তার দেশের আত্মসম্মান ও মর্যাদা রক্ষার জন্য তিনি এই সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হয়েছেন। তিনি তার পিকিং সফরের আগে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি না দিতে ব্রিটেনকে অনুরোধ করেছিলেন।

পরিত্যক্ত সম্পত্তির দায়িত্ব সরকারের

পূর্ত ও গৃহনির্মাণমন্ত্রী বলেন, ‘সরকার ঢাকা ও অন্যান্য স্থানে পাকিস্তানি ও তাদের দালালদের পরিত্যক্ত সব বাড়িঘর ও সম্পত্তির দায়িত্ব ভার গ্রহণের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এধরনের পরিত্যক্ত বাড়ির খোঁজ দিতে জনগণকে আহ্বান জানানো হয়। এর যাবতীয় তদারকি সরকারের পক্ষ থেকে করার ঘোষণা দেওয়া হয়। যেকেউ যেনো এসব বাড়িতে বেআইনিভাবে প্রবেশ না করে, সেবিষয়েও নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।’ এদিন পর্যন্ত ৬০ লাখেরও বেশি উদ্বাস্তু দেশে ফিরেছে। কলকাতা রাজ্য পুনর্বাসন দফতর থেকে এ তথ্য জানানো হয়েছে। তাদের মুখপাত্র জানান, বাংলাদেশে ফেরা উদ্বাস্তুদের পুনর্বাসনে ভারত একইসঙ্গে রিলিফও পাঠাচ্ছে।

হতাহত  ও নিখোঁজদের তথ্য জানানোর আহ্বান

প্রধানমন্ত্রীর সেক্রেটারিয়েট মুক্তিযুদ্ধে হতাহত ও নিখোঁজদের বিষয়ে তথ্য জানাতে আহ্বান জানিয়েছে। হতাহত ও নিখোঁজদের বিষয়ে বিস্তারিত বিবরণ নির্ধারিত ফর্মে পাঠাতে হবে এবং খামের ওপরে ‘বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে শহীদ, আহত ও নিখোঁজ ব্যক্তিদের বিস্তারিত বিবরণ’ এই কথাগুলো লিখতে হবে।

শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এই বিভাগের আরো খবর
All rights reserved www.mzamin.news Copyright © 2023